আম গ্রীষ্মের অন্যতম রসালো ফল, যা পুষ্টিগুণে ভরপুর। এটি শরীরের ভিটামিনের অভাব পূরণের পাশাপাশি কর্মশক্তি যোগায়।

মৌসুমি ফল আমের পুষ্টিগুণ সম্পর্ক বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ‘খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান’ বিভাগের প্রধান ফারাহ মাসুদা বলেন, “আম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিটা-ক্যারোটিন ও ক্যালরি।”

তিনি আরও জানান, উদ্ভিজ্জ উপাদান থেকে সরাসরি ভিটামিন পাওয়া যায় না, বিটা-ক্যারোটিন ভিটামিন এ‘র কাজ করে। এছাড়া রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি, যা শরীরে শক্তি তৈরি করে। আমের আয়রন, আঁশ, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি ও খনিজ উপাদান শরীর সুস্থ সবল রাখতে সাহায্য করে।

কাঁচা আমের পুষ্টিঃ

করোনাভাইরাসের জন্য লকডাউনের সময়ে আমরা সেভাবে বাজারে যেতে পারছি না। কিন্তু বাজারে সবজির ডালিতে শোভা পাচ্ছে কাঁচা আম, যা ভীষণ উপকারী।

কাঁচা আমে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন এ এবং সির আধিক্য থাকে।
ভিটামিন এ চোখের জন্য খুব উপকারী। চোখের স্নায়ু ও মাংসপেশি শক্তিশালী করতে এর ভূমিকা অপরিহার্য।
আর ভিটামিন সি যুদ্ধ করে ছোঁয়াচে রোগের বিরুদ্ধে। দাঁত, চুল, নখ ভালো হওয়ার জন্য ভিটামিন সি যথেষ্ট জরুরি।
মুখের ভেতরের চামড়া উঠে যাওয়া, মাড়িতে ঘা হওয়া, ঠোঁটের কোনায় ঘা, ঠোঁটের চামড়া ফেটে যাওয়া—এসব অসুখ ভালো হওয়ার জন্য দরকার ভিটামিন এ এবং সি, যা রয়েছে কাঁচা আমে।

ভিটামিন বি সিক্স বা পাইরিডক্সিনও রয়েছে এই ফলে। পাইরিডক্সিন মানুষের মস্তিষ্কে গাবা নামের একধরনের হরমোন তৈরি করে, যা প্রতিরোধ করে স্ট্রোক ও মস্তিষ্কের অন্যান্য জটিল রোগ। এতে রয়েছে কপার নামের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা দেহে রক্ত বাড়াতে সাহায্য করে।
প্রি-বায়োটিক ডায়াটারি ফাইবার নামের জরুরি উপাদান রয়েছে কাঁচা আমে, যা পাকস্থলী, কোলন ক্যানসার প্রতিরোধ করে।
আমাদের দেহে রক্তের মধ্যে টক্সিন নামের কিছু উপাদান রয়েছে, যা দেহে রোগ তৈরি করে। এই টক্সিনকে ধ্বংস করে কাঁচা আম।
গর্ভবতী মায়েরা কাঁচা আম খেলে বাচ্চার মেধা ভালো হয়, জন্মের পর বাচ্চার সংক্রামক রোগগুলো তুলনামূলকভাবে কম হয়।
চর্বি কমাতে, ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করে কাঁচা আম। যেকোনো কাটাছেঁড়া বা অপারেশনের পর এই ফল কাটা স্থান দ্রুত শুকাতে সাহায্য করবে।
তবে ফল অতিরিক্ত টক হলে খাবেন না। এতে কাটা স্থান শুকানোর পরিবর্তে ডায়রিয়া হতে পারে। হালকা টক খাওয়াই উত্তম। আবার বেশি উপকারের আশায় কাঁচা আম অতিরিক্ত মরিচ দিয়ে বেশি খেলে ডায়রিয়া হতে পারে। ডায়রিয়া চলাকালে কাঁচা আম খাবেন না। এতে ডায়রিয়া বেড়ে যেতে পারে। এই ফলে উচ্চ মাত্রার পটাশিয়াম রয়েছে। পটাশিয়াম হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য কাঁচা আম বয়ে আনে সুফল।

তবে খেয়াল রাখতে হবে, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্‌রোগীরা কাঁচা আম লবণ বা চিনি দিয়ে খাবেন না। কাঁচা লবণ রক্তচাপ বাড়ায় আর চিনি বা মিষ্টি রক্তের সুগার বাড়ায়।

ডায়াবেটিসের রোগীরা এই ফল খেতে পারবেন। কারণ, কাঁচা আমে চর্বি বা কোলেস্টেরল নেই, তাই এই ফল খেলে ওজন বেড়ে যাওয়ার বা ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। হৃদ্‌রোগীদের জন্য এটি উপযুক্ত ফল। আর কাঁচা আমে ভিটামিন সি পাকা আমের তুলনায় অনেক বেশি। তাই পুষ্টির বিচারে কাঁচা আম হোক আপনার পরিবারের সদস্য।
কাঁচা আম সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে খাওয়াই ভালো। রাতে খাবেন না, অ্যাসিডিটি বা গ্যাস হতে পারে। আর কাঁচা আমের আমসত্ত্বও ভীষণ উপকারী। তবে টাটকা কাঁচা আমে পুষ্টিগুণ বেশি।

দীর্ঘদিন ধরে আচার বানিয়ে সংরক্ষণ করলে সেটা খেতে ভালো লাগলেও পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। তাই টাটকা খাওয়া উচিত। শিশুদেরও কাঁচা আম খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এতে তাদের দাঁত, চুল, নখ, ত্বকে পুষ্টি সরবরাহ হবে। কারণ, বাড়ন্ত শিশুদের ভিটামিন সি খুব দরকারি। আর ভিটামিন সি আমাদের শরীরের চাহিদা মেটানোর পর তা আর আমাদের দেহে সংরক্ষিত হয় না। তাই ভিটামিন সি দরকার হয় নিয়মিত। আর কাঁচা আম খাওয়ার পরই দুধ বা দুধজাতীয় খাবার থেকে কিছু সময় বিরত থাকবেন।

পাকাআমের পুষ্টিগুণঃ

রসালো ফল আম। শুধু খেতেই সুস্বাদু নয়, রয়েছে শরীরের জন্য উপকারী নানান উপাদান।
মৌসুমি ফল আমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ‘খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারাহ মাসুদা বলেন, “আম নানান পুষ্টি উপাদানে ভরপুর যা শরীর সুস্থ রাখার পাশাপাশি কর্মশক্তি যোগাতেও সহায়তা করে।”

আমের পুষ্টি গুণ সম্পর্কে তিনি জানান:

পাকাআমে ক্যারোটিনের মাত্রা বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম আমে ২৭৪০ মাইক্রো গ্রাম ক্যারোটিন থাকে। এতে ১.৩ গ্রাম আয়রণ, ১৪ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ১৬ মি.গ্রা. ফসফরাস, ১৬ মি.গ্রা. ভিটামিন সি, ০.৯ মি.গ্রা. রিভোফ্লেভিন এবং ০.০৮ মি.গ্রা. থায়ামিন থাকে।

এছাড়াও পাকাআমে রয়েছে ভিটামিন বি-১ ও বি-২। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকাআমে ০.১ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-১ ও ০.০৭ মি.গ্রা. বি-২ রয়েছে।

প্রতি ১০০ গ্রাম পাকাআমে ০.৫ গ্রাম খনিজ লবণ থাকে। এতে কিছু পরিমাণ প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে। যেমন- প্রতি ১০০ গ্রাম পাকাআমে ১ গ্রাম প্রোটিন ও ০.৭ গ্রাম ফ্যাট থাকে।

আম শ্বেতসারের ভালো উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকাআমে ২০ গ্রাম শ্বেতসার পাওয়া যায়।

পাকাআমের উপকারিতা সম্পর্কে ফারাহ মাসুদা বলেন, “এর পুষ্টি উপাদান শরীরের নানাভাবে শক্তি যুগিয়ে ও ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করে মানবদেহ সুস্থ রাখতে সহায়ক।”

যেমন-

– আমের ক্যারোটিন চোখ সুস্থ রাখে, সর্দি-কাশি দূর করে।

– কার্বোহাইড্রেইট কর্মশক্তি যোগায়।

– আমের আয়রন অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে।

– ক্যালসিয়াম হাড় সুগঠিত করে, হাড় ও দাঁতের সুস্থতা বজায় রাখে।

– আম থেকে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ভিটামিন সি স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে। দাঁত, মাড়ি, ত্বক ও হাড়ের সুস্থতা রক্ষা করতেও সাহায্য করে ভিটামিন সি।

– এর পটাশিয়াম রক্ত স্বল্পতা দূর করে ও হৃদযন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে।

– এই ফলের আঁশ, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা হজমে সহায়তা করে। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করে।

– আম কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, রক্তস্বল্পতা ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।

– পাকাআম রক্তে কোলেস্টেরলের ক্ষতিকর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

অনেকেই মনে করেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের পাকাআম খাওয়া ঠিক নয়। এটা ভুল ধারনা।

পরিমিত পরিমাণ আম খেলে শরীরে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকে। তাই ডায়াবেটিকরা পরিমিত পরিমাণে পাকাআম খেতে পারেন বলে জানান এই অধ্যাপক।

আমের আরো কিছু পুষ্টিগুনঃ

আম মানেই তাতে নানা রকম ভিটামিনের মিশ্রণ। আম শরীরের নানা রোগ প্রতিরোধ করে ও পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, ক্যালোরি, ভিটামিন এসসি ক্যালশিয়াম, সোডিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম।

আমের উপকারিতাঃ
১.আমে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকায় অ্যানেমিয়ার সমস্যায় উপকারী।
২.ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় কনস্টিপেশন দূর করে।
৩.কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৪.শরীরে পটাশিয়ামের অভাব দূর করে।
৫.শরীরে এনার্জি বাড়াতে সাহায্য করে।
৬.পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম প্রচুর পরিমাণে থাকায় এসিডিটি, মাসল ক্যাম্প, স্ট্রেস ও হার্টের সমস্যায় উপকারী।
৭.ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ কাঁচা আম চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
৮.শরীরে কোলেস্টেরল লেভেল কম রাখতে সাহায্য করে।
৯.ভিটামিন-সি প্রচুর পরিমাণে থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
১০.গরমের সময় সর্দিতে আম উপকারী।
১১.হজমের দুর্বলতা কমাতে সহায়ক।
১২.কিডনির সমস্যায় সাহায্য করে।
১৩.এসিডিটি উপশমে ভালো কাজ করে।
১৪.আম দিয়ে শরবত তৈরি করে খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
১৫.আম পিপাসা মেটাতে সহায়তা করে।
১৬.আম লিভার ভালো রাখে।
১৭.ভিটামিন-সি প্রচুর পরিমাণে থাকায় আম ব্লাড ডিজঅর্ডারের সমস্যাতেও উপকারী।
১৮.চোখের কর্ণিয়া নরম হয়ে যাওয়া, বিফ্রেকটিভ সমস্যায়ও আম উপকারী।
১৯.আম যথেষ্ট পরিমাণে খেলে হেলদি এপিথেলিয়াম তৈরি হয়।
২০.সাইনাসের সমস্যা অনেকটা কমে যায়।
২১.আমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি থাকে।

আমের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতাঃ
১.সব সময় পরিষ্কার করে আম খেতে হবে।
২.অতিরিক্ত পরিমাণে আম খাবেন না। এ থেকে গলার সমস্যা হতে পারে।
৩.অতিরিক্ত আম খেলে হজমের সমস্যা হয়।
৪.আম অতিরিক্ত মরিচ মিশিয়ে খাবেন না।
৫.আম খাওয়ার পরপরই পানি খাবেন না।
৬.অতিরিক্ত পরিমাণে আম খেলে শারীরিক নানা সমস্যা হতে পারে; যেমন চোখে ইনফেকশন, ব্লাড ইমপিউরিটি, সিজনাল ফিভারের সমস্যা।